রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৩১ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

হৃদয় ভাঁজে কারবালা

এস এম আরিফুল কাদের:
কারবালার ঘটনায় কাঁদেন না এমন মুসলমান পাওয়া অসম্ভব। তবে এই ঘটনা ও এর প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয় নিয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক মতভেদ। এসব মতভেদে আড়াল হয়ে আছে নিরেট কিছু সত্য, যা অনেকেরই অজানা। অন্যদিকে বিষাদময় এ ঘটনায় জড়ানো হয়েছে অতিরঞ্জিত ও লোকমুখে প্রসিদ্ধ অনেক বিষয়। যা ইতিহাসে মিশ্রণ ঘটিয়ে সত্য-মিথ্যার মিশেলে নানা রটনা জন্ম দিয়েছে, ফলে অনেকে ভুলতে বসেছে, প্রকৃত সত্য কথা।

হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর দুই বছর খেলাফত শেষে হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে হজরত মুয়াবিয়া (রা.) পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতক-মুনাফিক ঝাপটা মেরে বসেছিল। চেষ্টার কমতি রাখেনি সোনালি যুগের ইসলাম ও মুসলমানদের ফাঁদে ফেলে ইসলামকে মিটিয়ে দিতে।

জেনে রাখা উচিত, মুসলমানদের মিটিয়ে দিলেও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না; ইসলাম ছিল, আছে ও থাকবে। আর সেই সুযোগ পেতেই এসব ‘আস্তিন কা সাপ’ নবী করিম (সা.)-এর সময় থেকে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা পর্যন্ত লেগে ছিল। অহি নাজিলের মাধ্যমে নবী করিম (সা.)-কে প্রকৃত সত্য জানিয়ে দেওয়ায়, তারা সফল হতে পারেনি ফলে ঘটনা ধারাবাহিকভাবে কারবালা পর্যন্ত আসে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার দুটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, বিশ্বাসঘাতক মুনাফিকদের উসকানি। দ্বিতীয়ত, নবী করিম (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী। মুসলমানরা প্রত্যেকেই এক দেহের মতো। দেহের কোথাও আঘাত পেলে যেমন সমস্ত শরীর তা জানতে পারে, তেমনি পৃথিবীর কোথাও মুসলিম আক্রান্ত হলে তাদের সহযোগিতা করা।

নবী করিম (সা.) মুসলমানদের উদ্দেশে ইরশাদ করেন, ‘মুমিনদের উদাহরণ তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়ার্দ্র্রতা ও সহানুভূতির দিক থেকে এক মানবদেহের মতো, যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তার সমস্ত দেহে ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা।’ সহিহ মুসলিম : ৬৪৮০

এ আদর্শে চলছিল নবী করিম (সা.)-এর জীবদ্দশা থেকে খোলাফায়ে রাশেদার সোনালি যুগ পর্যন্ত। তা দেখে বিশ্বাসঘাতক-মুনাফিকরা অস্থির হয়ে পরস্পরে বিবাদ লাগানোর চেষ্টা করে। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর খেলাফতকালে আবু লুলু নামক এক বিশ্বাসঘাতকের হাতে শাহাদতবরণ করেন। তাকে শহীদ করেই ক্ষান্ত হয়নি। তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)-কে আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা নামক আরেক বিশ্বাসঘাতক শহীদ করে। অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহের কাছে গুজব ছড়িয়ে দেয়, হজরত আলি (রা.) চক্রান্ত করে হজরত উসমান (রা.)-কে হত্যা করিয়ে নিজে খলিফার মসনদে বসেছেন। এই ক্রান্তিলগ্নে হজরত আয়েশা (রা.)-সহ বেশ কয়েকজন সাহাবি হজরত আলি (রা.)-এর কাছে এই বলে পাঠান যে, তিনি যেন হজরত উসমান হত্যাকারীদের দ্রুত কিসাসের ব্যবস্থা করেন। হজরত আলি (রা.) এ দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। তাতে সাবায়িরা ভয় পেয়ে নতুন করে ফন্দি আঁটতে শুরু করে; হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত আলি (রা.)-এর মধ্যে বাধিয়ে দেয় যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে বড় বড় অনেক সাহাবি শাহাদতবরণ করেন। যাকে উষ্ট্রীর যুদ্ধ বলা হয়। যুদ্ধের পর সাবায়ি ও তার দোসররা চক্রান্ত অব্যাহত রেখে মুসলিমদের দু’দলে বিভক্ত করে। একদল- অতিরিক্ত আলি ভক্তি ও অপর দল- আলি বিদ্বেষী। এই বিদ্বেষীরা আবার দু’দলে বিভক্ত। একদল- নাসিবি, অপরদল- খারিজি। সাবায়িদের এই চক্র হজরত আলি (রা.) ও হজরত মোয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে বাধিয়ে দেয় সিফফিনের যুদ্ধ। ওই যুদ্ধেও হাজার হাজার মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। সাবায়িদের প্রতারণায় খারিজিরা হজরত আলি (রা.)-কেও শহীদ করে।

চার খলিফার পর সাবায়িরা তৎকালীন বিশিষ্ট বুজুর্গ হাজার বিন আদিকে অনুপ্রাণিত করে হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হোসাইন (রা.)-কে হজরত মোয়াবিয়া (রা.)-এর বিরোধিতা করতে। উল্লেখ্য, বিন আদি সাবায়িদের চক্রান্তে শিকার হয়ে অবশেষে সাহাবি বিদ্বেষী (হজরত মোয়াবিয়া রা.-এর বিরোধিতা এবং ইমামদ্বয় (রা.) সাবায়িদের মতানুযায়ী না হওয়ায় তাদেরও বিরোধিতা শুরু করে) হয়ে যায়।

হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হোসাইন (রা.)-এর থেকে হজরত মোয়াবিয়া (রা.)-এর প্রতি আনুকূল্য জবাব পেয়ে দুষ্ট চক্রগুলো আরও জ্বলে উঠেও ব্যর্থ হয়। ইসলাম ও মুসলিম ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে হজরত মোয়াবিয়া (রা.) এতই কঠোর ছিলেন যে, তার ২১ বছরের খেলাফতকালে ইবনু সাবায়ি গোষ্ঠী কিছুই করতে সাহস পায়নি। ৬০ হিজরিতে আমিরে মোয়াবিয়া (রা.) ইন্তেকাল করলে ইবনু সাবায়ির প্রেতাত্মারা মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ করে। বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস : ২২

আমিরে মোয়াবিয়া (রা.)-এর ইন্তেকালের পূর্বে ইয়াজিদ ইবনে মোয়াবিয়াকে ইসলামি আইনানুযায়ী খলিফা নির্বাচিত করা হয়। ইমাম হোসাইন (রা.) দ্বীন ও ইমানের আলোকে স্বার্থমুক্ত ও আন্তরিক সিদ্ধান্ত ছিল- ইয়াজিদ ইবনে মোয়াবিয়া খেলাফতের অযোগ্য। এ মতপ্রকাশের সুযোগে সাবায়িদের ষড়যন্ত্র তুমুল আকার ধারণ করে। সাবায়িরা কুফা থেকে কুফার অধিবাসী সেজে প্ররোচনামূলক চিঠি লিখে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে। যা আমন্ত্রণপত্রের স্তূপ বলে ঐতিহাসিকরা বর্ণনা দিয়েছেন। -ইতিহাসের কাঠগড়ায় হযরত মুয়াবিয়া (রা.) : ৮২ ও ১২৪

এতসব চিঠি ও বার্তা পেয়ে কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পরীক্ষামূলক ইমামের চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে পাঠালেন। সেখানে তাকে মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে শহীদ করা হয়। শাহাদতের পূর্বে কোনো এক সময় ইমাম হোসাইন (রা.)-কে চিঠি পাঠানোর পর চিঠি পৌঁছার আগেই মুসলিমকে হত্যা করা হয়। এ সংবাদ ইমামের কাছে না পৌঁছায় তিনি কুফার দিকে রওনা হলেন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি কুফাবাসীদের এ বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে কোনো তথ্য ছিল না ইমাম পরিবারের কাছে। তিনি প্রায় কুফায় পৌঁছেই গিয়েছিলেন।

৬১ হিজরির ৩ মহররম ইমাম হোসাইন (রা.)-কে ইবনে যিয়াদ বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয় ফোরাত নদীর তীরে। ১০ মহররম সকালে কারবালার প্রান্তরে এ মর্মান্তিক ট্রাজেডি সংঘটিত হয়।

হজরত আলি (রা.) শহীদ হওয়ার পর ইমাম হাসান (রা.)-এর খেলাফতের ৬ মাস যেতে না যেতেই ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে স্ব-ইচ্ছায় ইমাম হাসান (রা.) ও আমিরে মোয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। কারণ, উষ্ট্রী এবং সিফফিন যুদ্ধের মতো মুসলিমদের রক্ত আর দেখতে না চাওয়ায় এ শান্তিচুক্তি হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আর সে সম্পর্কেই নবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ‘হাসান বসরি (রহ.) বলেন, আমি আবু বকর (রা.)-কে বলতে শুনেছি- হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আমি মিম্বরের ওপর দেখেছি। হজরত হাসান বিন আলি (রা.) তার পাশে ছিলেন। তিনি একবার লোকদের দিকে আরেকবার তার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, আমার এ সন্তান একজন নেতা। সম্ভবত তার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে মীমাংসা করাবেন।’ -সহিহ বোখারি : ২৭০৪

মুহাদ্দিসরা হাদিসটিকে শান্তিচুক্তির ভবিষ্যদ্বাণী বলে উল্লেখ করেন। আর হজরত হোসাইন (রা.) সম্পর্কে নবী কারিম (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল- ‘হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ভূমিতে হোসাইনকে শহীদ করা হবে জিবরাইল আমাকে সে স্থানের মাটি দেখিয়েছেন। যে ব্যক্তি হোসাইনের রক্ত ঝরাবে সে মহান আল্লাহর রোষানলে পতিত হবে। হে আয়েশা! এ ঘটনা আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। আমার উম্মতের মধ্যে কে সেই ব্যক্তি যে আমার হোসাইনকে শহীদ করবে?’ -কানজুল উম্মাল : ১২

মুহাদ্দিসরা এই হাদিসকে কারবালার মর্মান্তিক ট্রাজেডির ভবিষ্যদ্বাণী বলে উল্লেখ করেছেন। সর্বোপরি, সোনালি সেই যুগ থেকে অদ্যাবধি মুসলমানদের পর্যুদস্ত করতে ইবনে উবাই, ইবনে সাবার প্রেতাত্মারা বিভিন্ন নামে, রঙে ও ভাষায় এসে ধোঁকা দিচ্ছে। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ঐশী চিন্তার মাধ্যমে রুখে দাঁড়ালে পুনরায় কারবালা ট্রাজেডির মতো ঘটনা ঘটানো অসম্ভব। তাই মুসলমানদের মহান প্রভু পূর্বোল্লিখিত হাদিস মোতাবেক একই দেহের মতো হয়ে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন।

ভযেস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION